ইহুদিদের ইতিহাস মানে এক ভয়ংকর যন্ত্রণা ও অবিচারের ইতিহাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা ইউরোপে নির্যাতিত হয়েছে, একের পর এক তাদের উপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে। এমনকি যখন হিটলার ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের জন্য পৃথিবী যেন এক অন্ধকার গর্তে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাদের উপর চলে এসেছিল অমানবিক অত্যাচারের খড়গ। হিটলার যে গণহত্যা চালায়, তাতে প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদি নিহত হয়। তখন, ইহুদিরা বুঝে যায়, তাদের অস্তিত্বের জন্য একমাত্র পথ হলো নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা, যেখানে তারা নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে পারবে। তবে, এই স্বপ্নটি ছিল শুধুমাত্র এক দেশের অধিকারী হওয়ার ইচ্ছা নয়, বরং এটি ছিল এক জাতির আত্মরক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা।
ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্যালেস্টাইন কেন? এর পিছনে ছিল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় ভাবনা। প্যালেস্টাইন ছিল ইহুদিদের প্রাচীন মাতৃভূমি, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী এটি ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের জায়গা। প্যালেস্টাইন, যে স্থানটি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতীক, যেখানে প্রাচীন ইহুদিরা বসবাস করতেন, সেই জায়গাটিকে পুনরায় তাদের রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ইহুদিরা বদ্ধপরিকর হয়। এই জায়গাটি তাদের জন্য শুধু একটি ভূখণ্ড ছিল না, এটি ছিল তাদের বিশ্বাস, তাদের পরিচয়, তাদের ইতিহাসের অংশ। তাই, প্যালেস্টাইন ছিল তাদের মুক্তির পথ, তাদের ভবিষ্যতের ভিত্তি। পশ্চিমারা তখন ইহুদিদের এই স্বপ্নের পূরণে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে, কিন্তু তাদের সহায়তা ছিল এক সঙ্ঘবদ্ধ উদ্দেশ্য নিয়ে। ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে বসতি স্থাপনের পেছনে পশ্চিমাদের ছিল এক সাংঘাতিক পরিকল্পনা। প্যালেস্টাইন মুসলিমদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল—এটি ছিল তাদের প্রথম কেবলা, এটি ইসলামের ঐতিহাসিক স্থান। তাই, পশ্চিমারা বুঝে গিয়েছিল যে যদি প্যালেস্টাইন মুসলিমদের হাতে থাকে, তাহলে তাদের জন্য আরব বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করা কঠিন হবে। তাছাড়া, প্যালেস্টাইন ছিল ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব কারণেই, পশ্চিমারা ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে জমি কিনতে সহায়তা করে, তাদের অস্তিত্বকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসে। তবে, এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক স্বার্থ, যা পুরো আরব বিশ্বে শক্তির পরিসর সম্প্রসারণে সহায়ক হতে পারতো।
ইহুদিরা যখন প্যালেস্টাইনে আসতে শুরু করে, তারা সরাসরি প্যালেস্টাইন এল না, বরং পশ্চিমা শক্তিগুলোর সহায়তা নিয়ে তারা এই ভূমি কিনতে শুরু করে। বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে ব্রিটেন, তাদের অর্থ দিয়ে প্যালেস্টাইনে জমি কিনতে সাহায্য করেছিল। প্যালেস্টাইনের মুসলিম শাসক, সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়, ইহুদিদেরকে প্যালেস্টাইনে জমি বিক্রি করতে বাধা দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে, প্যালেস্টাইনকে “অমুসলিমদের হাতে” তুলে দেওয়া হবে না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় অধিকার এখানে রয়েছে এবং এটি বিক্রি করা যাবে না। তার শাসনের সময় প্যালেস্টাইন ছিল শান্তিপূর্ণ, যেখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টানরা একসাথে বসবাস করত। কিন্তু পশ্চিমাদের সহায়তায় এবং তাদের অর্থের বিনিময়ে ইহুদিরা এখানে জমি কিনতে সক্ষম হয়। তাদের জমি কেনার প্রক্রিয়া ছিল মূলত ফিলিস্তিনের বড় মুসলিম জমিদারদের কাছ থেকে, যারা নিজেদের জমির মালিক হলেও ফিলিস্তিনের বাইরে বসবাস করতেন, যেমন বেইরুট, দামেস্ক, কায়রো। এই জমিদাররা অনেক সময় ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রি করতেন, যা কৃষক আরবরা চাষ করত। ফলস্বরূপ, যদিও ইহুদিরা জমির বৈধ মালিকানার দলিল পেত, তবে জমিতে বসবাসরত আরব কৃষকরা বিতাড়িত হতো এবং ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
প্রথম দিকে ইহুদির সংখ্যা ছিল খুবই কম এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে কৃষিকাজ শুরু করেছিল, তাই ফিলিস্তিনিরা এটিকে বড় হুমকি মনে করেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। এরপর ১৯২০ সালে ব্রিটেন ফিলিস্তিনের উপর ম্যান্ডেট লাভ করে এবং ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ব্যালফোর ঘোষণা দিয়ে জানায় যে, ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি “জাতীয় আবাসভূমি” প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি ইহুদিদের জন্য একটি নতুন শক্তি হিসেবে কাজ করে এবং ইউরোপ থেকে তাদের অভিবাসন আরও বাড়ে। এছাড়া, হাগানা, ইরগুন, এবং লেহি নামক গোপন সামরিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের রক্ষা করতে এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের হাত থেকে ইহুদিরা ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়। প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি নিহত হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে তাদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়। এর ফলে, ইউরোপ থেকে লাখ লাখ ইহুদি ফিলিস্তিনে আসার চেষ্টা করতে থাকে।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয়েছিল ফিলিস্তিনকে দুটি ভাগে ভাগ করা হবে:
- একটি ইহুদি রাষ্ট্র
- একটি আরব রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম থাকবে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে।
ইহুদিরা এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে, কারণ এতে তাদের জন্য স্বাধীনতা লাভের সুযোগ ছিল। কিন্তু আরবরা (ফিলিস্তিনিরা এবং আশেপাশের আরব দেশগুলি) এই পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তারা মনে করেছিল তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ (প্রায় ৭০%) হওয়ার পরও কেন নিজেদের ভূমির বড় অংশ ছেড়ে দিবে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এর পরের দিন, আশেপাশের আরব দেশগুলি (মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধের ফলে, ইসরায়েল তার জাতিসংঘের নির্ধারিত সীমার চেয়ে আরও বেশি জমি দখল করে।
ফলস্বরূপ, প্রায় ৭ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে পড়ে, ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর ধ্বংস হয়ে যায়, এবং নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনা “নাকবা” (বিপর্যয়) হিসেবে চিহ্নিত করে।
এর পরবর্তী পরিস্থিতি ছিল কঠিন এবং অন্ধকারময়। ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেনি, এবং তারা এক আশায় দিন কাটিয়েছে যে, কখনো তারা তাদের হারানো ভূমিতে ফিরে আসবে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল দ্রুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর স্বীকৃতি পেয়ে যায়, যা তাদের আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি আরও বৃদ্ধি করে। এরপর একের পর এক যুদ্ধ (১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩) চলতে থাকে, কিন্তু শান্তি আসেনি।
এই সংঘাত, যা সদ্য স্বাধীন এক জাতির প্রতিষ্ঠা এবং তার সঙ্গে জড়িত মানুষের অত্যাচার ও শোকের গল্প, আজও বিশ্ব রাজনীতিতে এক অম্লমধুর চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। বহু বছর ধরে এই সংগ্রাম মানবতার জন্য এক বড় পাঠ, যেখানে অধিকার, ভূমি, জাতীয়তাবাদ, এবং শান্তির সন্ধান এক অপরিহার্য দ্বন্দ্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংঘাতের ইতি না হওয়া পর্যন্ত, প্রতিটি মানুষ, পরিবার, এবং জাতি যেন ভবিষ্যতে এক শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রেরণা পায়।