প্রেক্ষাপটঃ
১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু স্বাধীনতার সাথে সাথে দেশভাগও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের দাবিতে মুসলিম লীগ চাইছিল পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’, আর কংগ্রেস চাইছিল স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত।
এই টানাপোড়েনের মাঝেই বাংলা প্রদেশের ভাগের প্রশ্ন উঠে আসে।
বাংলা ভাগের কারণঃ
বাংলা ছিল একদিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ (পশ্চিম বাংলা) আর অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (পূর্ব বাংলা)।
মুসলিম লীগ চাইছিল পুরো বাংলা পাকিস্তানে যোগ দিক।
কংগ্রেস চাইছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হোক।
এই দ্বন্দ্বের ফলেই বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
বাংলাভাগের বিরুদ্ধেঃ United Bengal Plan
বাংলা ভাগের বিরুদ্ধেও তখন বড় ধরনের একটা প্রস্তাব উঠে —
“United Bengal Plan” বা “একক, স্বাধীন বাংলা” পরিকল্পনা।
এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন:
শরৎ চন্দ্র বসু (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বড় ভাই)
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী)
আবুল হাশিম (মুসলিম লীগ নেতা)
তাদের দাবি ছিলঃ
বাংলা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা উচিত নয়।
হিন্দু-মুসলিম মিলেই বাংলা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে।
এর মাধ্যমে রক্তপাত ও বিদ্বেষ এড়ানো সম্ভব হবে।
তারা চাইছিলেন ব্রিটিশদের কাছে এই পরিকল্পনার অনুমোদন আদায় করতে।
তবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ সরকার কেউই এই পরিকল্পনাকে পুরোপুরি সমর্থন করেনি।
ফলে United Bengal Plan বাস্তবায়িত হয়নি।
ভাগের সিদ্ধান্তঃ
শেষমেশ ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের জুন মাসে সিদ্ধান্ত নেয়:
বাংলা ভাগ হবে।
পশ্চিম বাংলা (হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল) ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হবে।
পূর্ব বাংলা (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল) পাকিস্তানের অংশ হবে।
সীমানা নির্ধারণঃ
ব্রিটিশ সরকার স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ-কে দায়িত্ব দেয় বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা ঠিক করার জন্য।
তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে (মাত্র পাঁচ সপ্তাহে) সীমারেখা নির্ধারণ করেন, যা ইতিহাসে “র্যাডক্লিফ লাইন” নামে পরিচিত।
ফলাফলঃ
বাংলা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়:
পশ্চিম বাংলা → ভারতবর্ষে রইল।
পূর্ব বাংলা → পাকিস্তানের পূর্ব অংশ হল, যার নাম পরে হয় পূর্ব পাকিস্তান।
বাংলার মানুষকে ভয়ানক রকমের ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে হয়।
বিশাল মানবিক বিপর্যয় ঘটে — লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, সহিংসতার শিকার হয়।
ধর্মের নামে বিভাজন বাংলা মাটিতে গভীর ক্ষত তৈরি করে।
সংক্ষেপে এক নজরে:
বিষয় | বিবরণ |
---|---|
বাংলাভাগের কারণ | ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজনের চাপ |
বিরোধিতার চেষ্টা | United Bengal Plan (শরৎ বসু, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম) |
কেন বিরোধিতা সফল হয়নি | কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও ব্রিটিশ সমর্থন না করা |
সীমানা নির্ধারক | স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ |
ভাগের ফলাফল | পশ্চিম বাংলা (ভারত), পূর্ব বাংলা (পাকিস্তান) |
শেষ কথাঃ
১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগ শুধু ভূগোলের পরিবর্তন ছিল না;
এটি ছিল হাজার বছরের বাঙালি জাতিসত্তার হৃদয়ে এক চিরস্থায়ী ক্ষতের জন্ম।
আজও বাংলাভাগের স্মৃতি দুই বাংলার মানুষের মনে বেদনার এক ইতিহাস হয়ে আছে।