বাংলাদেশের রাজনীতি তো এক অদ্ভুত খেলা, যেখানে সাধারণ মানুষ গুটি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের জীবন, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভবিষ্যৎ—সবকিছুই কেবল রাজনৈতিক মহলের শখের পুতুলের মতো। খেলতে খেলতে আমাদের সব কিছুই মুছে যায়, কিন্তু খেলা থেমে যায় না। আমাদের অজান্তে, আমাদেরই জীবনের ওপর, রাজনৈতিক নেতারা খেলা চালিয়ে যান। আর আমরা সাধারণ মানুষ? আমরা তো শুধু দর্শক। কখনো গুটির মতো একপাশে ফেলে দেওয়া হয়, আবার কখনো এক টোকা দিয়ে মাঠে নিয়ে এসে পরের খেলায় যোগ দেওয়া হয়।
এটা কি বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্র নয়? খেলার নিয়ম, কে জানে! আমরাই তো খেলতে খেলতে ভুলে যাই—কি ছিল আমাদের গতকাল, আজ কী হচ্ছে, আর আগামীকাল কী হবে! আমাদের ইতিহাস—আমরা কি কখনো তার মূল্য দিতে পারব?
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়, এবং তারপর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের পুনর্গঠন শুরু হয়। কিন্তু কী হলো? স্বাধীনতার পর শুরু হলো এক অদ্ভুত নাটক, যেখানে বঙ্গবন্ধু নিজেই সঞ্চালক। স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁর নেতৃত্ব কতটা সফল ছিল, সে প্রশ্ন তো উঠবেই। প্রথমদিকে তাঁর কাজগুলো ভালোই যাচ্ছিল, তবে দেশ তখনো এক বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল, যেখানে তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো কখনো বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়নি। দেশের সমস্যা, দুর্নীতি, ও সঙ্কট নিয়ে কী করেছিলেন তিনি? অনেক সময়ই আমাদের চোখে তা মুছে ফেলা হয়েছিল।
নতুন পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করার চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু একটা সময় ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু সেটা তো দেশের মানুষের জন্য দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়ালো। তার ফলস্বরূপ, পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীন হওয়া দেশটি একটি নতুন ধরনের শাসনের জাঁতাকলে আটকা পড়ল, যেখানে বৈষম্য এবং দারিদ্র্য ছিল প্রতিনিয়ত।
শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর, ১৯৭৫ সালে খন্দকার মোস্তাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সরকার গঠন করে। এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অদ্ভুত এক ধাক্কা দিয়ে যায়। কিন্তু দেশের মানুষ কি জানত, তাদের অধিকার কীভাবে গলে গিয়ে চলে যাবে? যতই রাজনৈতিক দলগুলো পাল্টাতে থাকে, সাধারণ মানুষের জীবনে কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি।
এখানে আবারও সেই একই চক্র—রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল, দুর্নীতি, আর শাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার। কখনো এক দল, কখনো আরেক দল ক্ষমতায় এসে শুধু নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মানুষের হাড় ভেঙে দেয়, আর সাধারণ মানুষ ভুলে যায়। তারা আবারও এক নতুন নেতা বা দলের দিকে চোখ তাকিয়ে থাকে। আমাদের কি কোনো শিক্ষাও হয়নি?
এবার কথা বলি ৫ আগস্ট ২০২৪-এর বিষয়ে, যখন ছাত্র সমাজ এবং দেশের জনসাধারণ শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। দেশটাকে এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, যেখানে কিছুই সঠিক ছিল না। ৫ আগস্ট, সারাদিনটাতে কী হয়েছিল? ছাত্রদের প্রতিবাদ, জনতার ক্ষোভ—সব কিছু যেন এক নাটকীয় সমাপ্তির দিকে এগোচ্ছিল। শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের শাসন শেষ হয়েছিল, কিন্তু কি আসলেই পরিবর্তন হয়েছিল?
এই প্রতিবাদ, এই বিপ্লব—এটা কি কেবল রাজনৈতিক আক্রোশের ফল ছিল? নাকি, আমরা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারিনি, যে কীভাবে আমাদের ভবিষ্যতকে খেলোয়াড়রা হাতের পুতুলে পরিণত করেছে?
যেই ছাত্র সমাজ শেখ হাসিনার পতন ঘটাল, তারা তৈরি করল নতুন এক রাজনৈতিক দল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি কি পুরনো সেই চিত্রের মতো নয়? নতুন দলের মধ্যে ডানপন্থী-বামপন্থী বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা একে অপরকে কটাক্ষ করছে, নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের পরিমাণ বাড়ছে। যাইহোক, মতের অমিল থাকতেই পারে, কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের উদ্দেশ্যকে একে অপরের থেকে আলাদা করতে পারে? উদ্দেশ্য তো এক হওয়া উচিত—দেশকে ভালোভাবে পরিচালনা করা, সাধারণ মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা। কিন্তু নতুন দলের নেতাদের কথাবার্তা কখনো একরকম, কখনো অন্যরকম। মাঝে মধ্যে তাদের কথায় মনে হয়, কোনো ধরনের স্থিরতা বা সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য নেই।
এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলিম, তাদের আবেগ, তাদের বিশ্বাস, তাদের মূল্যবোধের সঙ্গে কেন যেন এক ধরনের বিরোধিতা চলতে থাকে। এটা কী সত্যি? এটা কোনো পরিস্থিতির মধ্যেও অবাঞ্চনীয় নয়? আবারও, নতুন দলের উচ্চপদস্থ নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ মুসলিমদের আবেগ নিয়ে খেলা করছে। তবে দলের অন্যান্য নেতাদের এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই। তাহলে কি তারা সবাই একমত, যে বামপন্থী রাজনৈতিক মতবাদ অনুসরণ করা উচিত, যা মুসলিম ধর্মের মূলনীতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক?
পাঁচ বছর পর পর আমরা নিজেরাই ভুলে যাই—কি হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, আর কেন হয়েছে। এক দলকে বিদায় দিয়ে অন্য দলের পক্ষে স্লোগান তুলি। শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল, কিন্তু কোনো এক সময়ে তার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়ে যায়। জনগণ ঐতিহাসিক ভুলগুলো ভুলে যায়, কিছু দিনের মধ্যে আবার সেই নেতাদের পক্ষে ভোট দেয়। তারা জানে না, তারা কেবল খেলার টোকা পেয়েছে।
এটা কোনো রাজনীতির পরিবর্তন নয়, এটা তো এক চক্রের পুনরাবৃত্তি! দল বদলাতে বদলাতে আমরা আবারও সেই একই ভুল করতে শুরু করি। পুরনো নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি, নতুন নেতাকে পুঁজি করি, আর একই গল্প ফের শুরু হয়।
আজ, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর ঘটনা আমাদের শেখাচ্ছে, যে, যদি আমরা পুরনো ইতিহাস ভুলে যেতে থাকি, যদি রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটমেন্ট বা সমালোচনা থেকে কোনো শিক্ষা না নেই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সাধারণ মানুষকে কেবল ব্যবহার করছে, আর আমরা সেই খেলায় অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছি।
আমরা কি কখনো এই খেলাটা থামাতে পারব? নাকি আমাদের আরও একবার ভুলে গিয়ে পরবর্তী ৫ বছরের জন্য নতুন “খেলোয়াড়” আসবে?